ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভের সামনে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এমপি পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন।
বরিসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেছেন আরও দুই এমপি। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের তিন এমপির পদত্যাগের ঘটনায় আবারও ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে পড়েছে ওয়েস্টমিন্সটার সরকার।
পত্রিকা ডেস্ক:
লণ্ডন, ১২ জুন: নানা কেলেঙ্কারির মুখে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়া বরিস জনসন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্য (এমপি) পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। ‘পার্টিগেইট কেলেঙ্কারির’ ঘটনায় দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনের জেরে গত শুক্রবার (৯ জুন) তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। করোনা মহামারির লকডাউনের মধ্যেও জন্মদিনসহ অন্যান্য পার্টি করায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছিল প্রিভিলিজেস কমিটি। জনসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, লকডাউনে পার্টি করেও হাউজ অব কমন্সের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন তিনি। তবে এ কমিটি রায় দেওয়ার আগেই সরে গেছেন তিনি। বরিস বলেন, ‘পার্লামেন্ট ছেড়ে আসাটা অত্যন্ত বেদনার বিষয়, অন্তত এমন এক সময়ে। তবে আমাকে যেভাবে জোরপূর্বক ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে এবং অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট উপায়ে পদচ্যুত করা হয়েছে, তাতে আমি হতভম্ব হয়েছি।’ বরিস জনসনের পর শনিবার এমপি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন নাদিন ডরিস এবং নাইজেল এডামস। দুজনেই কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য এবং বরিসের অনুসারী বলে পরিচিত।
তিন এমপির পদত্যাগের ঘোষণা এই তিনটি আসনে এখন উপ-নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে একতরফা সমর্থন এবং এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ আরও নানা কারণে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ সরকারের জনপ্রিয়তা কমতির দিকে। গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তার প্রমাণও পেয়েছে কনজারভেটিভরা। এ অবস্থায় এই তিনটি আসনে উপ-নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের নেতৃত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, এ তিনজনের পর যদি আরও এমপি পদত্যাগ করেন তাহলে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ওপর চাপ আরও বাড়তে থাকবে। ইতোমধ্যেই বিরোধী দল লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা ডেইসি কপার ও ইডি ডেভি নতুন সাধারণ নির্বাচন ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। ফলে সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই আবারও প্রধানমন্ত্রীর বদল কিংবা সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে। বরিস জনসনের নেতৃত্বে ২০১৯ সালের মধ্যমর্তী নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের বিপুল ভোটে বিজয়ের পর ইতিমধ্যে দুজন প্রধানমন্ত্রী বিদায় নিয়েছেন- বরিস জনসন ও লিজ ট্রাস। আর ২০১৬ সালের পর যুক্তরাজ্যে ৫ বার প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন ঘটেছে।
এখন প্রভাবশালী কনজারভেটিভ নেতা বরিস জনসনের পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের ঘটনায় আবারও সরকারে ভাঙ্গন ধরতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বরিসের ভাষ্য, প্রিভিলেজেস কমিটির প্রতিবেদনের কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁকে অন্যায়ভাবে এমপি পদ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে শুক্রবার সকালে প্রিভিলেজেস কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি হাতে পান জনসন। বরিসের মতে, ওই প্রতিবেদন হেঁয়ালি, অসত্য ও পক্ষপাতে পরিপূর্ণ। শুক্রবার সন্ধ্যায় দেওয়া এক বিবৃতিতে বরিস দাবি করেন, কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এমন একটি প্রমাণও হাজির করতে সক্ষম হয়নি যাতে প্রমাণ হয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে হাউস অব কমনসকে (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) বিভ্রান্ত করেছেন। এর আগে গত মার্চে বরিস তদন্ত কমিটির কাছে এটা স্বীকার করেছিলেন যে, করোনা-বিধি উপেক্ষা করে বন্ধুদের নিয়ে পানাহারের আয়োজন করার বিষয়ে তিনি পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। তবে তিনি এও বলেছিলেন যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তা করেননি। ২০২০-২১ সালে করোনা মহামারি চলাকালে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি ছিল। তখন লকডাউনের বিধি ভেঙে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস নিজ কার্যালয়ে একাধিক পানাহারের আয়োজন করে। যা নিয়ে তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এ বিষয়টিই ‘পার্টি গেট কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত। এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে বরিসকে ২০২২ সালের ৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হয়। এমপি পদ ছাড়লেও বরিস জনসন যে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন তেমনটি অবশ্য কেউ মনে করছেন না। কেননা, পদত্যাগপত্রে তেমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছে তিনি। বলেছেন, অন্তত কিছু সময়ের জন্য তিনি আর পার্লামেন্টে থাকছেন না। এর আগে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার সময় বলেছিলেন, আবার দেখা হবে।
কনজারভেটিভ দলের তৃণমূলে বরিসের ভালো সমর্থন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে বরিসের বিদায়ের জন্য ঋষি সুনাককেই দায়ী করেন তাঁর সমর্থকেরা। ফলে বরিসের সেইসব সমর্থকরা বরিসকে ফিরিয়ে আনতে ঋষি সুনাকের জীবন কঠিন করে তুলতে পারেন বলে মনে করেন অনেকেই। আর দুজন এমপির পদত্যাগ তারই ইঙ্গিত। ডেইসি কপার বলেছেন, ‘কনজারভেটিভ পার্টি গলে গেছে এবং তাদের অবশ্যই সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করতে হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমাদের স্বাস্থ্যখাত (এনএইচএস) এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর- এই বিশৃঙ্খল কনজারভেটিভ সরকার নিয়ে, সাধারণ মানুষকে সরাসরি মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে।’ বরিস জনসনের উত্থান-পতন রক্ষণশীল দলের রাজনীতিতে নেমে তরতর করে এগিয়ে গেছেন। একসময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন রক্ষণশীল দলের নেতা বরিস জনসন। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই যেন সবকিছু ওলটপালট হতে থাকে। একের পর এক বিতর্কে জড়াতে থাকেন তিনি। করোনাকালে বিধি লঙ্ঘন করে পার্টি আয়োজন করে বিতর্কিত হন। এমন আরও নানা কেলেঙ্কারির কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। সেটাও বছরখানেক আগের কথা। এবার পার্লামেন্ট থেকেও পদত্যাগ করেছেন কনজারভেটিভ দলের এই নেতা। করোনাবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বরিসের বিরুদ্ধে তদন্ত চলা অবস্থাতেই গত শুক্রবার ৫৮ বছর বয়সী এই নেতা অভিমান করে পার্লামেন্টের সদস্য পদও ছেড়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় করোনাবিধি ভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে বরিস বারবার পার্লামেন্টে মিথ্যা বলেছেন কি না, তা নিয়েই ওই তদন্ত হচ্ছিল। বরিস একে ক্যাঙারু কোর্ট হিসেবে উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ, নানা বিতর্ক অতঃপর পদত্যাগ ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতির মধ্য দিয়ে বরিস জনসনের নেতৃত্বাধীন টোরি দল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়। এরপর পার্লামেন্টের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার চুক্তিটি অনুমোদন করান তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যে কয়েক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হয়। ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে সক্ষম হলেও করোনা মহামারি পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি বরিস জনসন।
পার্টি গেট কেলেঙ্কারিসহ (লকডাউনবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ) বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কারণে গত বছরের জুলাইয়ে মন্ত্রীদের বিদ্রোহের মুখে পড়েন তিনি। এমন অবস্থায় তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের পরও গুঞ্জন ওঠে, জনসন হাল ছাড়বেন না। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তিনি আবারও লড়বেন। তবে জনসনের বিরুদ্ধে এসব বিতর্ক নতুন কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও বিভিন্ন সময়ে নানা বিষয়ে বিতর্কে জড়ান তিনি। ‘দাম্ভিকতা’ ব্যক্তিগত জীবনে বরিস জনসন তিনটি বিয়ে করেছেন। তাঁর সন্তান আটজন। ইটন কলেজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন বরিস জনসন। ইটনে শিক্ষকদের কাছে তিনি দাম্ভিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বরিস চাইতেন, তাঁকে যেন ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বরিস জনসনের মনোভঙ্গি এমন ছিল যে যত নিয়ম সব অন্য মানুষের জন্য।