চমৎকার আয়োজন : অভূতপূর্ব উদ্যোগ
লণ্ডন, ২২ জুলাই: যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার দশ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা দিয়েছে মুসলিম কমিউনিটি এসোসিয়েশন (এমসিএ)। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে সার্বিক সহযোগিতা এবং সমাজের বৃহত্তর কমিউনিটির মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের কাজ করে যাওয়ার মাধ্যমে মানবিক অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে এই বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
ব্রিটেনের মুসলমান কমিউনিটি থেকে অমুসলিমদের প্রশংসাসূচক এ ধরনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দানের উদ্যোগ এ প্রথম।
গত ২১ জুলাই শুক্রবার লন্ডন মুসলিম সেন্টারে এমসিএ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানকে ব্রিটেনে ধর্মীয় সম্প্রীতির উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং কমিউনিটির বন্ধনকে সুদৃঢ়করণে একটি মাইলফলক উদ্যোগ হিশেবে দেখা হচ্ছে।
ব্রিটেনের বৃহৎ মুসলিম কমিউনিটি সংগঠন এমসিএ’র প্রথম এই উদ্যোগে এমনসব ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানানো হয়েছে যারা মুসলিম না হয়েও মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছিলেন সোচ্চার, যারা মানুষের মানবিক অধিকার রক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় অধিকারকে উচ্চাসনে রেখে একে-অন্যের প্রতি সহমর্মী হয়ে একটি সম্প্রীতিপূর্ণ ও গতিশীল সমাজগঠনের জন্য এক অনুসরণীয় অবদান রেখেছেন।
জাঁকজমকপূর্ণ এই সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, কাউন্সিলার, সাংবাদিকসহ কমিউনিটির বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, এমসিএ ভিন্নধর্মের গুণী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তিত্বদের পুরস্কৃত করে যে সম্মান প্রদর্শন করেছে সেটা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। ইসলাম যে তাঁর অনুসারীদেরই শুধু পরধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা প্রদান করেনা, বরং সাথে সাথে এই মহান ধর্মের আলোতে আলোকিত অনুসারীদেরকে সাম্য, সম্প্রীতি ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ এবং মানবিক মর্যাদা সংরক্ষণে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এসব কাজের জন্য অন্যদের স্বীকৃতি দেয়াটাও যে জরুরী ইসলামের সেই শিক্ষাটিই এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা হলো।
অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তাগণ অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের সমাজের সত্যিকারের ‘হিরো’আখ্যা দিয়ে বলেন, তারা ভিন্ন ধর্মকে শুধু সম্মানিতই করেননি বরং মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নে সক্রিয় থেকে একটি শান্তিপূর্ণ ও উন্নত সমাজ গঠনে অনন্য অবদান রেখেছেন। তারা তাদের প্রতিটি কাজে ইসলামের প্রতি ও এর অনুসারীদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় ছিলেন এক একজন দিকপাল।
এমসিএ’র এই সম্মাননা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার মানুষ আরো বেশী মানবিক কাজে উৎসাহিত করবে বলে অনুষ্ঠানে আশা প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে লন্ডন ছাড়াও যুক্তরাজ্যর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমন্ত্রিত প্রায় পাঁচশত বিভিন্ন পেশাজীবি ব্যক্তিবর্গ অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে মোট ১০টি সম্মাননা প্রদান করা হয়। কমিউনিটি কোহিশন বা সামাজিক সম্প্রীতি ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন ইস্ট লন্ডন সেন্ট্রাল সিনাগগের প্রেসিডেন্ট লিওন সিলভার এবং রানার্স আপ হিসাবে নির্বাচিত হন ইন্টারন্যাশনাল ডেপোলাপম্যান্ট এজেন্সির সাবেক আন্তর্জাতিক পরিচালক ডেনিস হস, কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন কমিউনিটির সেভ দ্য চিলড্রেন, চিলড্রেন সোসাইটি ও সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস-এবং ‘সিটিজেন ইউকে’র প্রতিষ্ঠাতা নীল জেমসন এবং রানার্স আপ হন পপলার ও লাইমহাউস একশন ফর হাউজিং-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সিস্টার ক্রিস্টিন ফ্রস্ট এমবিই, শিক্ষা ও উন্নয়ন ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন বিশিষ্ট সাংবাদিক পিটার ওবোর্ন্ ওবিই এবং রানার্স আপ হিসেবে হন কে্টর্স একাডেমির প্রিন্সিপাল জন কেটি মার্শাল, কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার বিভাগে বিজয়ী হন নরউইচ সিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন কাউন্সিলার ও নিবেদিত সমাজকর্মী ভন থমাস এবং রানার্স আপ হন সেন্ট জন্স বেথনাল গ্রিনের রেভারেন্ড প্রিবেন্ডারি অ্যালান গ্রিন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সাম্য ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হন শামী চক্রবর্তী হিশেবে সমধিক পরিচিত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, ব্যারিস্টার এন্ড হিউম্যান রাইটর্স এক্টিভিস্ট ব্যারোনেস শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী সিবিই এবং রানার্স আপ হন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টের ইন্টেলিজেন্স এণ্ড সিকিউরিটি কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্রিটেনের সাবেক এটর্নি জেনারেল ডমিনিক গ্রিভ, কেসি।
ইমাম আবদুর রহমান এবং ইমাম মুজ্জামিল আহমেদের অনুবাদসহ পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক সুলতান আহমেদ।
মুসলিম কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাওলানা মুসলেহ ফারাদি’র স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য রুশনারা আলী এমপি, আফসানা বেগম এমপি, টাওয়ার হ্যামলেটেসের নির্বাহি মেয়র লুৎফুর রহমানের পক্ষে ডেপুটি মেয়র কাউন্সিলার মায়ূম তালুকদার, মুসলিম কাউন্সিল অফ ব্রিটেনের সেক্রেটারি জেনারেল জারা মোহাম্মদ (এমসিবি), সাবেক সেক্রেটারি ডা: সুজা সাফি, ইসলাম চ্যানেলের সিইও মুহাম্মদ আলী, নরউইচ কাউন্সিলের লিডার মাইক স্টোনার্ড, ইউকে ইসলামিক মিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড: মুহাম্মদ আরিফ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হাসনাত হোসেন এমবিই প্রমূখ বক্তব্য রাখেন এবং সম্মাননাপ্রাপ্ত এবং তাদের প্রতিনিধিদের হাতে ক্রেস্ট, সনদ তুলে দেন। এওয়ার্ডপ্রাপ্তদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও চেক তুলে দিতে অতিথিবৃন্দের সাথে ছিলেন ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের চেয়ারম্যান আইয়ুব খান, এমসিএ’র প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হাবিবুর রহমান, দিলওয়ার হোসেন খান, আতিকুর রহমান জিলু, এমসিএ’র সাধারণ সম্পাদক হামিদ হোসাইন আজাদ, সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল মতিন চৌধুরী।
মুসলেহ ফরাদী তাঁর বক্তব্যে বলেন, “জীবনে আমরা অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু মুসলিম কমিউনিটির জন্য এই অনুষ্ঠান বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া এবং ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে বর্তমান পরিবেশ কখনও কখনও ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলির আন্তরিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়। সেসব বাধা কাটিয়ে যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের সংহতিকে উৎসাহিত করতে সক্রিয়ভাবে জন্য কাজ করে চলেছেন এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সহায়তা করছেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ এই অবদানের স্বীকৃতি এবং ইতিবাচক কাজে উৎসাহ দিতেই মূলত মুসলিম কমিউনিটি সার্ভিস অ্যাওয়ার্ডস (এমসিএসএ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
মুসলেহ ফরাদী ফারাদী একটি সৌহার্দপূর্ণ সমাজ গঠনে এমসিএর ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, এই তৃণমূল সংগঠনটি মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক হৃদ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর সুফল বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ সংগঠনটি বিভিন্ন উপায়ে সমাজিক কাজে অংশগ্রহণ ও সমাজের মানুষের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব কর্মকাণ্ডকে বেগবান ও উৎসাহিত করার নিমিত্তে যারা ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় সমাজে অবদান রাখছেন, এমন একটি সুন্দর পরিবেশে তাদেরকে সম্মাননা জানানো এমসিএ খুবই তাৎপপূর্ণ বলে মনে করে। কেননা তাদের সাহসী ও সময়োপযোগী উদ্যোগের মাধ্যমে একদিকে সমাজ ইসলামোফোবিয়াসহ বহু সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে, অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং সম্মানবোধ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে।
তিনি অনুষ্ঠানে আগত সকলকে স্বাগত জানিয়ে ‘মুসলিম কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, ভলান্টিয়ার, মিডিয়া পার্টনার, ডোনার, স্পন্সরসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
স্বাগত বক্তব্যের পর এমসিএ’র কার্র্যক্রমের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
এওয়ার্ড প্রদানের পূর্বে চার সদস্যবিশিষ্ট বিচারক প্যানেলের চেয়ার, মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অফ হাইয়ার এডুকেশনের রেক্টর ড. জাহিদ পারভেজ ও তার টিমের পরিচিতির পর বিচারক প্যানেলের চেয়ার ডঃ জাহিদ পারভেজ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
সমাপনী বক্তব্য রাখেন এমসিএর কেন্দ্রীয় জেনারেল সেক্রেটারী ব্যারিস্টার হামিদ হোসাইন আজাদ। তিনি তাঁর বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সফলতার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটি, অতিথিবৃন্দ এবং বিচারকমন্ডলীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান ভাল কাজের স্বীকৃতি ও উৎসাহ প্রদানে এক মাইলফলক হিসাবে কাজ করবে। তিনি এ অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা রক্ষার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আশা করি আমরা সকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর সমাজ উপহার দেওয়ার লক্ষ্যে আরো বেশী ভাল কাজ করার অদম্য উৎসাহ নিয়ে এ অনুষ্ঠান থেকে ফিরে যাব।”