হৃদরোগে আক্রান্তদের সময়মতো হাসপাতালে নিলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জীবন বাঁচানো যেতে পারে
লণ্ডন, ০২ অক্টোবর: হৃদরোগে আক্রান্তদের সময়মতো হাসপাতালে নিলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে জীবন বাঁচানো যেতে পারে। কারণ, দ্রুত চিকিৎসা পেলে হার্ট অ্যাটাক থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। আর এজন্য তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য পেতে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্য লক্ষণগুলো জানা অপরিহার্য।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিশ্ব ‘হার্ট’ দিবসে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা এসব কথা জানান। বিশ্ব ‘হার্ট’ দিবস উপলক্ষে এনএইচএস নর্থ লণ্ডন কার্ডিয়াক অপারেশনাল ডেলিভারি নেটওয়ার্ক-এর প্রচারাভিযানের অংশ হিশেবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিলো।
উল্লেখ্য, ২৯ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বের সব মানুষকে তাদের হৃদযন্ত্রের যতেœর প্রতি মনোযোগী করতে এ দিবস পালন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অন্যান্যদের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা মানুষের মধ্যে ‘করোনারি হার্ট ডিজিজে’ আক্রান্তের হার ৫০ শতাংশ বেশি। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধানতম ঝুঁকি এটি। কাজেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ এবং এর থেকে দ্রুত সুস্থতা পাওয়ার জন্য সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
‘প্রথমেই আমাদের হার্টকে জানি’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এনএইচএস নর্থ লণ্ডন কার্ডিয়াক অপারেশনের ডেলিভারি নেটওয়ার্ক’-এর এ বছরের প্রচারাভিযান চলছে। জীবন বাঁচাতে হৃদরোগে আক্রান্তের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন করাই এই প্রচারাভিযানের মূল লক্ষ্য। দ্রুত সাহায্য পাওয়ার জন্য হৃদরোগে আক্রান্তের সম্ভাব্য লক্ষণ এবং নিরাপদ নয় এমন বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা অপরিহার্য।
উল্লেখ্য, ব্যক্তিভেদে হৃদরোগে আক্রান্তের লক্ষণ ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে বুক চেপে আসা বা অস্বস্তি হওয়া হৃদরোগে আক্রান্তের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই অনুভব করেন। প্রতি ক্ষেত্রেই যে এই লক্ষণগুলোই গুরুতরভাবে দেখা যাবে তা নয়। কেউ কেউ অন্য রকমও অনুভব করতে পারেন, যেমন শ্বাসকষ্ট, অসুস্থ বোধ করা এবং পিঠ বা চোয়ালে ব্যথা। এসব ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা না-ও থাকতে পারে। কেউ যদি হৃদরোগে আক্রান্তের এসব লক্ষণ অনুভব করেন তাহলে তার অবশ্যই ৯৯৯-এ ফোন করা উচিত।
পরিসংখ্যান মতে, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত সাতজন সেরে ওঠেন। সেরে ওঠার এই হার প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয়জনে উন্নীত করা যেতে পারে যদি রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়। সংবাদ সম্মেলনে নিউহামের জিপি ডা. ফারজানা হোসেইন লিখিত বক্তব্যে?বলেন, হৃদরোগে আক্রান্তের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ বুকে ব্যথা যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এছাড়া হৃদরোগে আক্রান্তের বাকি লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুকে ব্যথা, চাপ, ভার অনুভব করা। শরীরের অন্য অংশে ব্যথা অনুভব করা (এমন মনে হতে পারে, বুক থেকে শরীরের অন্য অংশে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে) যেমন দুই হাত, কাঁধ, চোয়াল, পিঠ ও পেট। মাথা হালকা বোধ হওয়া বা মাথা ঘোরা। ঘাম হওয়া, শ্বাসকষ্ট অথবা বমি বমিভাব বা বমি হওয়া। তীব্র অস্থিরতা বোধ কিংবা কফ বা কাশি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাউথ উডফোর্ডের ইংরেজি শিক্ষক আসিফ হক তাঁর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, সময় মতো চিকিৎসা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে। মধ্য চল্লিশে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘কী ঘটছে তা অস্বীকার না করে চিকিৎসা নেয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে আপনার লক্ষণগুলো খুব গুরুতর মনে হচ্ছে না। তবে বিষয়টি আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে। আমার মনে হচ্ছিল (হার্ট অ্যাটকের সময়) আমার খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়েছে। ঘাড়ের ঠিক পেছনে পাকস্থলির ওপরের অংশে ব্যথা হচ্ছিল। পরবর্তী তিনদিন এই ব্যথা একইভাবে অব্যাহত ছিল। এরপরই আমার মনে হয়, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উঠিত। ইসিজি করার পর আমি বুঝতে পারি, বিষয়টি কতটা গুরুতর। আমি যদি আরো আগে সাহায্য চাইতাম তাহলে আমার হার্ট ৩০ শতাংশ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারত। এনএইচএস ইংল্যাণ্ড পরিচালিত সমীক্ষা থেকে বলছে, ‘হার্ট অ্যাটাক’ ও ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ অর্থাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা নিয়েই সন্দিহান বহু মানুষ। লণ্ডনে সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী দুই-তৃতীয়াংশ দক্ষিণ এশীয় এই দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। প্রতি চারজনে একজন (৩৮%) মনে করেন, হার্ট অ্যাটকেরই আরেক নাম কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট যা গুরুতর ভুল।
উল্লেখ্য, হার্টে রক্ত সরবরাহ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়। এমন পরিস্থিতি হলে হার্টে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় যা পেশিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি জ্ঞান হারান না, তার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয় না। ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হঠাৎ করে এ সংকট দেখা দেয়। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই ওই ব্যক্তি জ্ঞান হারান। তাদের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তাদের পালস খুঁজে পাওয়া যায় না। এ সময় কোনো চিকিৎসা দেয়া সম্ভব না হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ে এনএইচএস ইংল্যাণ্ড প্রকাশিত এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, লণ্ডনে দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত এই সমীক্ষায় দেখা গেছে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫২%) হৃদরোগে আক্রান্তের লক্ষণগুলো চেনার ব্যাপারে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী নন। তারা মনে করেন, লক্ষণগুলো তারা না-ও চিনতে পারেন। এছাড়া লণ্ডনে বসবাসকারী প্রায় অর্ধেক (৪৬%) দক্ষিণ এশীয় জানিয়েছেন, তাদের বা তাদের কাছের মানুষের বুকে ব্যথা উঠলেও তারা ৯৯৯-এ ফোন করবেন না। অথচ সবাই জানে, বুকে ব্যথা হচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্তের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ।
লণ্ডনের বার্টস হার্ট সেন্টার এবং ইউসিএলের কনসালটেন্ট কার্ডিওলোজিস্ট অধ্যাপক রিয়াজ প্যাটেল লণ্ডনবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, হৃদরোগে আক্রান্তের সম্ভাব্য লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আপনার বা আপনার কাছের কারো মধ্যে যদি হৃদরোগে আক্রান্তের কোনো লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে প্রথমেই আপনার উচিত ৯৯৯-এ ফোন করা। চিকিৎসক হিসেবে আমরা আপনাদের দ্রুততম সময়ে মধ্যে আমাদের সামনে দেখতে চাই। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। হৃদরোগে আক্রান্তের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা এবং সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হলে প্রাণ বাঁচানো সহজ হয়। এনএইচএস প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইংল্যাণ্ডে ২০২১/২২ সালে হৃদরোগে আক্রান্তের কারণে ৮৪ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় যা এর আগের বছরের তুলনায় ৭ হাজার বেশি। কোভিড-১৯ মহামারির ওই সময়ে অবশ্য অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্তের অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে যেতে ভয় পেতেন।