ইসলামপুর শাখা ওয়ান ব্যাংকের গ্রাহক লণ্ডন প্রবাসী আব্দুর রউফ। পরিশ্রমের আয়ের বেশকিছু অর্থ তিনি জমা রেখেছিলেন তাঁর এই ওয়ান ব্যাংক একাউন্টে। তাঁর চেক ও স্বাক্ষর জাল করে ওই ব্যাংকেরই এক কর্মকর্তা মোঃ সরফরাজ আলী পাপলু (ওরফে শরীফ আলী পাপলু) হাতিয়ে নিয়েছেন ৮৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বিষয়টি ধরা পড়ার পর চার বছরের বেশি সময় পার হলেও তিনি তাঁর টাকা ফেরত পাননি।
এদিকে, অর্থ জালিয়াতি মামলার প্রধান আসামী ব্যাংকটির সাবেক ক্যাশিয়ার সরফরাজ আলী পাপলুর ওপর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিনি সম্প্রতি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। জানা গেছে, স্ত্রীকে যুক্তরাজ্যের স্টুডেন্ট ভিসায় আবেদন করান তিনি। আর স্ত্রীর ডিপেণ্ডেন্ট হয়ে দুই সন্তানসহ যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন পাপলু। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তের ভিত্তিতে ব্যাংকের সাবেক ক্যাশিয়ার সরফরাজ আলী পাপলুসহ তিনজনকে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেয়া হয়। বাকী দুজন আসামী হলেন- ওয়ান ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার সাবেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও ম্যানেজার অপারেশন জাবেদ এমদাদ চৌধুরী এবং সাবেক কাস্টমার সার্ভিস অফিসার দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ ডিসেম্বর সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের শুনানীতে জাবেদ এমদাদ চৌধুরী ও দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য হাজির হন। আদালত তাদের জামিন না দিয়ে জেলে প্রেরণ করে। কিন্তু প্রধান আসামী সরফরাজ আলী পাপলু শুনানীতে হাজির হননি। এর কয়েকদিন পর তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। আসামী মোঃ সফররাজ আলী পাপলুর বাড়ি সিলেট জেলার শাহপরান থানার শিবগঞ্জের লাকরী পাড়ায়। তিনি মোঃ আহসান আলীর সন্তান।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ে যখন নানা অসন্তোষ ও সমালোচনা চলছে, তখন ওয়ারেন্ট এবং ত্যাশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও গ্রাহকের আমানত আত্মসাৎ করার দায়ে অভিযুক্ত সরফরাজ আলী পাপলু কীভাবে দেশত্যাগে সক্ষম হলেন- তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের প্রশাসন বিচার নিশ্চিতে কতটা আন্তরিক ও সক্ষম সে প্রশ্নও উঠেছে। ভুক্তভোগী আব্দুর রউফ বলছেন, মানুষ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। কিন্তু সেই ব্যাংক থেকে আমানত হাওয়া হয়ে যাবে, আর ব্যাংক কোনো দায়িত্ব নেবে না- দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেলো! তিনি বলেন, ব্যাংক এই টাকার কোনো দায়িত্ব নেয়নি। উল্টো অর্থ আত্মসাৎকারী সরফরাজ আলী পাপলুর দায়ের করা একাধিক মিথ্যা মামলায় তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন দফায় দফায়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভুক্তভোগী আব্দুর রউফের বাংলাদেশের পৈত্রিক নিবাস সিলেটের বালাগঞ্জের হুসেনপুরে। তিনি দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কিচমত বিরাহিমপুর গ্রামে বাড়ি করেছেন।
আব্দুর রউফ বলেন, দক্ষিণ সুরমায় তাঁর বাড়ির পাশেই সরফরাজ আলী পাপলুর শ্বশুর বাড়ি। সেই সূত্রে ২০১১ সালের দিকে পাপলুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। পাপলুই উৎসাহ দিয়ে তাঁকে ওয়ান ব্যাংকে একাউন্ট খোলান। তিনি একাউন্ট খুলেছিলেন ২০১২ সালে। শুরু থেকেই তিনি এই একাউন্টে বিভিন্ন সময়ে টাকা জমা রাখছিলেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে জমা টাকার গরমিল ধরা পড়ে। ‘২০১৮ সালের শেষের দিকে আমি দেশে যাই। দেশে যাওয়ার পরদিনই পাপলু ও স্ত্রী আমার বাসায় আসে দেখা করতে। পাপলু আমাকে বেশ কয়েকবার বলে যে, ব্যাংকে যাওয়ার আগে যাতে তার বাসা হয়ে যাই। এতে আমার মনে সন্দেহ জাগে। যে কারণে পাপলু ও তাঁর স্ত্রী আমার বাসা থেকে বিদায় নেয়ার পরপরই আমি একটি গাড়ি নিয়ে ব্যাংকে চলে যাই। আর একাউন্ট চেক করে দেখি একাউন্টে টাকা নাই। মোট ৮৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।’ বলছিলেন ভুক্তভোগী আব্দুর রউফ।
২০১৪ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০১৭ সালের ২৮ মে সময়ের মধ্যে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। আব্দুর রউফ জানতে পারেন, কয়েক মাস আগে পাপলু ওয়ান ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শুরুতে ব্যাংকের কর্মকর্তারা দাবি করেন, আব্দুর রউফ নিজেই চেকের মাধ্যমে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন বা তুলে নিয়েছেন। তখন নিজের কাছে থাকা চেক বই দেখিয়ে প্রমাণ করেন যে, তিনি টাকা তুলেননি। তখন ধরা পড়ে যে, স্বাক্ষর জাল করে আরেকটি চেক বই ইস্যু করা হয়। আর ওই চেক দিয়েই টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি সফররাজ আলী পাপলুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলেন, ‘আপনি আমাকে না জানিয়ে কেন ব্যাংকে গেলেন?’ আব্দুর রউফ বলেন, ‘ওইদিন পাপলু তাঁর পরিবারের লোকজন নিয়ে আবার আমার বাসায় আসে। সবকিছু শিকার করে বলে আমার টাকা সে ফেরত দেবে। ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রতিশ্রুতিমত শুরুতে ২৬ লাখ টাকা ফেরতও দেন। যে কারণে তিনি তাঁকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেন।’ সবমিলিয়ে প্রথম ৬ মাসে ফেরত পান ৩১ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এরপর ৫ টাকার একটি চেক ডিসঅনার হয়। তখন থেকেই নানা টালবাহানা শুরু করে দেয় পাপলু। ব্যাংক থেকেও বিষয়টি নিয়ে কোনো সুরাহা পাচ্ছিলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে লণ্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন আব্দুর রউফ। এরপর সরফরাজ আলী পাপলু তাঁর বিরুদ্ধে একটি মানহানির মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। আব্দুর রউফ বলেন, ‘২০২০ সালে করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ থাকলেও আমার বিরুদ্ধে মামলা আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়েছে। করোনার কারণে দেশে যেতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়ে যায়। পাপলু পুলিশ নিয়ে আমার বোনের বাড়ি যায়। আমার বাড়ি যায়। মালামাল নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। একেকবার পুলিশের এক এক টিম আসে আর হুমকি-ধামকি দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের বৌকে পাঠিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে বিষয়টি জানানোর পর ওই হয়রানি বন্ধ হয়।’ তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে ওই মামলার হাজিরা দেয়ার জন্য দেশে যাই। কিন্তু সিলেট বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেখি পাপলু আগে থেকেই দুইজন সিভিল ড্রেসের পুলিশ এবং সাংবাদিক নিয়ে অপেক্ষায়। তাঁরা আমাকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে আদালতে নিতে চায়। আমি আপত্তি জানাই এবং আমার গাড়িতে পুলিশকে নিয়ে কোর্টে যাই। ওইদিন ম্যাজিট্রেট সবকিছু দেখে এবং আমার বক্তব্য শুনে মামলা সাথে সাথে খারিজ করে দেন।’ ‘২০২১ সালে পাপলু তাঁর ওপর সন্ত্রাসী হামলা করেছি উল্লেখ করে আরেকটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ওই মামলাও সাজানো বিবেচনায় তিন মাসের মাথায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে খারিজ হয়ে যায়।’ বলছিলেন আব্দুর রউফ।
আব্দুর রউফ বলেন, তিনি আগে মামলার কথা চিন্তা করেননি। কিন্তু ২০১৯ সালে মানহানির মামলার পর তিনি পাপলু ও ব্যাংক ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করেন। সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটি সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রেরণ করে। দুদক কয়েক দফা আব্দুর রউফকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ৯৯ টি স্বাক্ষর নেয়। বিশেষজ্ঞ দিয়ে এসব স্বাক্ষর যাচাই করানো হয়। দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব স্বাক্ষরে চেক বই ও টাকা তোলা হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে আব্দুর রউফের স্বাক্ষরের মিল নেই। এছাড়া পাসপোর্টের তথ্য যাচাই করে দুদকের রিপোর্টে বলা হয়, আব্দুর রউফের নামে কিছু বেশকিছু লেনদেন ঘটেছে যখন তিনি দেশেই ছিলেন না।
এই প্রতিবেদন দুদক সিলেট দায়রা জজ আদালতে দাখিল করে। তদন্তের ভিত্তিতে দুদক ব্যাংকের তৎকালীন ক্যাশিয়ার সফররাজ আল পাপলু, ওয়ান ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার সাবেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও ম্যানেজার অপারেশন জাবেদ এমদাদ চৌধুরী এবং সাবেক কাস্টমার সার্ভিস অফিসার দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য- এই তিনজনকে আদালতে হাজির হওয়ার আদেশ দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ ডিসেম্বরের শুনানীতে ব্যাংকের আইনজীবীদের সঙ্গে জাবেদ এমদাদ চৌধুরী ও দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য আদালতে হাজির হন। এই দুজনকে জামিন না দিয়ে জেলে প্রেরণ করে আদালত। কিন্তু পাপলু আদালতে হাজিরা না দিয়ে কয়েকদিন পর লণ্ডনে চলে আসেন। আব্দুর রউফ বলেন, দুদক তাঁকে জানিয়েছিলো আসামীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে।
ভুক্তভোগী আব্দুর রউফ সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে আরেকটি মামলা করেছেন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণসহ আমানতের টাকা ফেরত চেয়ে। গত অক্টোবরে দায়ের করা ওই মামলায় ক্ষতিপূরণসহ মোট ৪ কোটি ১৫ লাক্ষ ২ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছে। জানুয়ারিতে এই মামলার শুনানী হওয়ার কথা।
আব্দুর রউফ বলেন, ‘এ ঝামেলায় আমার ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ খরচ হয়ে গেছে। যদি বাংলাদেশ থাকে, সরকার থাকে, ব্যাংক থাকে এবং বিচার থাকে – তাহলে আমার টাকা ফেরত পাবো। অন্যায়ের বিচার পাবো। অন্যথায় মানুষ কোন ভরসায় ব্যাংকে টাকা রাখবে। এমন হলে তো মানুষের সম্পদেরও কোনো মূল্য নাই। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে যে কেউ নিয়ে নিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না।’ তিনি বলেন, ওয়ারেন্ট থাকা অবস্থায় পাপলুর দেশ থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিনি চান যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন উদ্যোগী হয়ে পাপলুকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করুক। বাংলাদেশে মামলার দীর্ঘসূত্রীতা এবং পুলিশের কিছু সদস্যের অন্যায় আচরণের কথা উল্লেখ করে আব্দুর রউফ বলেন, বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত। বিশেষ করে প্রবাসীরা যাতে দ্রুত বিচার পায় সেটি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।
আব্দুর রউফ বলেন, ‘ব্যাংকের মত নিরাপদ কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা জমা রেখে এমন বিপদে; পড়বো কখনো ভাবিনি। এখন বিচার পেতে জীবন সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। সন্তানরা আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমার হয়রানির ঘটনায় তারা বাংলাদেশে আর কিছুই রাখতে চায় না। এটা দেশের জন্য খারাপ বার্তা। আমরা প্রবাসীরা দেশকে অনেক ভালোবাসি। সবকিছু দেশেই করতে চাই। সরকারের উচিত হবে দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের এই বন্ধন টিকিয়ে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।’ দুটি মিথ্যা মামলা থেকে খালাস পাওয়া এবং দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও ভালো মানুষ আছে এবং বিচার আছে। তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশাবাদী। মোঃ সফররাজ আলী পাপলুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তাঁর বক্তব্য পেলে তা তুলে ধরা হবে। তবে বাংলাদেশে প্রকাশিত একাধিক সংবাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থ জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পাপলু।